মুসলমান শাসনের সূচনাকালকে বাংলায় মধ্যযুগের শুরু বলা হয় । ইতিহাসে এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবেশ করতে হলে বিশেষ কতকগুলো যুগান্তকারী পরিবর্তন দরকার। মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের ফলে বঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই শুধু পরিবর্তন আসেনি; এর ফলে বঙ্গের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
মজুমদার সাহেব তার লিমিটেড কোম্পানি পরিচালনার জন্য ঘনিষ্ঠ লোক ফরহাদকে নিয়োগ করেন। মজুমদার ও এরফান পাঠানের মধ্যে ব্যবসায়িক শত্রুতা রয়েছে। ইতিমধ্যে এরফান পাঠান মজুমদার সাহেবকে পরাজিত করার জন্য ফরহাদের সাথে গোপনে চক্রান্ত করে। ফলে ফরহাদ বিশ্বাসঘাতকতা করে পাঠানের কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার ঘটায় পক্ষান্তরে মজুমদারকে পরাজিত করে।
রিমা সেন্টাল লাইব্রেরিতে বই পড়তে গিয়ে একটি বইয়ের কাতা পেজে দেখতে পায় স্বাধীন সুলতানি আমল (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.) লেখা রয়েছে। কৌতূহলী হয়ে সে বইটি পড়তে শুরু করে ।
তেরো শতকের শুরুতে তুর্কি বীর ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর- পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। ইতিহাসে তিনি বখতিয়ার খলজি নামেই বেশি পরিচিত । তাঁর বংশ পরিচয় সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না । তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কি, বংশে খলজি এবং বৃত্তিতে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক ।
বখতিয়ার খলজি স্বীয় কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজ জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে জীবিকার অন্বেষণে গজনিতে আসেন। সেখানে তিনি শিহাবউদ্দিন ঘোরির সৈন্য বিভাগে চাকরিপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন । দেখতে খাটো, অস্বাভাবিক লম্বা হাত এবং কদাকার চেহারার জন্য বখতিয়ার সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হন। এরূপ শারীরিক বৈশিষ্ট্য তুর্কিদের নিকট অমঙ্গল বলে বিবেচিত হতো। গজনিতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল্লিতে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের দরবারে উপস্থিত হন। এবারও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি বদাউনে যান । সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দিন তাকে মাসিক বেতনে সৈন্য বিভাগে নিযুক্ত করেন । কিন্তু উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার এ ধরনের সামান্য বেতনভোগী সৈনিকের পদে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি । অল্পকাল পর তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যা যান। সেখানকার শাসনকর্তা হুসামউদ্দিনের অধীনে তিনি পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে নিযুক্ত হন । বখতিয়ারের সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় সন্তুষ্ট হয়ে হুসামউদ্দিন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ভাগবত ও ডিউলি নামক দুটি পরগনার জায়গির দান করেন। সেখানে বখতিয়ার তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান। ভাগবত ও ডিউলি তার শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
বখতিয়ার অল্পসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে শুরু করেন । এ সময়ে তার বীরত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভাগ্যান্বেষী মুসলমান তার সৈন্যদলে যোগদান করে। ফলে বখতিয়ারের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এভাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে তিনি দক্ষিণ বিহারে এক প্রাচীরঘেরা দুর্গের মতো স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। প্রতিপক্ষ কোনো বাধাই দিল না। দুর্গ ভায়ের পর তিনি দেখলেন যে, দূর্গের অধিবাসীরা সকলেই মুণ্ডিত মস্তক এবং দুর্গটি বইপত্রে তরা । জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন যে, তিনি এক বৌদ্ধ বিহার জর করেছেন। এটি ছিল দন্দ বিহার বা ওদন্তপুরী বিহার। এ সময় থেকেই মুসলমানেরা এ স্থানের নাম দিল বিহার। আজ পর্যন্ত তা বিহার নামে পরিচিত।
বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার অনেক ধনরত্নসহ দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুলতান কর্তৃক সম্মানিত হয়ে তিনি বিহার ফিরে আসেন। অধিক সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি পরের বছর নবদ্বীপ বা নদীয়া আক্রমণ করেন। এ সময় বাংলার রাজা লক্ষণ সেন নদীয়ার অবস্থান করছিলেন। গৌড় ছিল তাঁর রাজধানী, আর নদীরা ছিল তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী। বখতিয়ার কর্তৃক বিহার জয়ের পর সেন সাম্রাজ্যে গভীর ভীতি বিদ্যমান ছিল। দৈবজ্ঞ, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণগণ রাজা লক্ষণ সেনকে রাজধানী ত্যাগ করতে পরামর্শ দেন। তাদের শাস্ত্রে তুর্কি সেনা কর্তৃক বঙ্গ জরের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। এছাড়া বিজয়ীর যে বর্ণনা শাস্ত্রে আছে, তার সঙ্গে বখতিয়ারের দেহের বর্ণনা একেবারে মিলে যায় । কিন্তু তবুও রাজা লক্ষণ সেন নদীয়া ত্যাগ করেননি ।
বিহার থেকে বাংলায় প্রবেশ করতে হলে তেলিয়াগড় ও শিড়িপড়—এই দুই গিরিপথ দিয়ে আসতে হতো। এ গিরিপথ দুটো ছিল সুরক্ষিত। তিনি প্রচলিত পথে অগ্রসর হলেন না। কিন্তু অরণ্যময় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়াতে বখতিয়ারের সৈন্যদল খণ্ড খণ্ড ভাবে অগ্রসর হয়। শত্রুপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে বখতিয়ার এলজি যখন নদীয়ার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিল মাত্র ১৭ কিংবা ১৮ জন অশ্বারোহী সৈনিক। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খলজির পক্ষে বঙ্গ বিভার কী করে সম্ভব হলো? কথিত আছে, তিনি এ ক্ষিপ্রগতিতে পথ অতিক্রম করেছিলেন যে, মাত্র ১৭/১৮ জন সৈনিক তাঁকে অনুসরণ করতে পেরেছিল। আর মূল সেনাবাহিনীর বাকি অংশ তাঁর পশ্চাতেই ছিল ।
তখন দুপুর। রাজা লক্ষণ সেন মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত; প্রাসাদ-রক্ষীরা তখন আরাম-আয়েশ করছে: নাগরিকগণও নিজেদের প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত। বখতিয়ার খলজি বণিকের ছদ্মবেশে নগরীর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছান। রাজা লক্ষণ সেন তাদের অশ্ব ব্যবসায়ী মনে করে নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেন। কিন্তু এ ক্ষুদ্র দল রাজপ্রাসাদের সম্মুখে এসে হঠাৎ তরবারি উন্মুক্ত করে প্রাসাদ রক্ষীদের হত্যা করে । অকস্মাৎ এ আক্রমণে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। প্রাসাদ অরক্ষিত রেখে সকলে প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় । ইতোমধ্যে বখতিয়ারের দ্বিতীয় দল নগরের মধ্যে এবং তৃতীয় দল তোরণ-দ্বারে এসে উপস্থিত হয়। সমস্ত নগরী তখন প্রায় অবরুদ্ধ । নাগরিকগণ ভীত-সন্ত্রস্ত। এ অবস্থায় রাজা লক্ষণ সেন হতাশ হয়ে পড়েন । শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই দেখে তিনি পিছনের দরজা দিয়ে সপরিবারে খালি পায়ে গোপনে নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন । অল্প সময়ের মধ্যে বখতিয়ার খলজির পশ্চাদ্গামী অবশিষ্ট সৈন্যদলও এসে উপস্থিত হলো । বিনা বাধায় নদীয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। বখতিয়ার খলজির নদীয়া জয়ের সঠিক তারিখ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে বর্তমানে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দই নদীয়া জয়ের সময় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ।
এরপর বখতিয়ার নদীয়া ত্যাগ করে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসর হন । তিনি লক্ষণাবতী অধিকার করে সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন । লক্ষণাবতীই মুসলমান আমলে লখনৌতি নামে পরিচিত হয় । গৌড় জয়ের পর বখতিয়ার আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার বিস্তার করেন । এখানে উল্লেখ্য যে, বখতিয়ার খলজি নদীয়া ও গৌড় বিজয়ের পর একটি স্বাধীন রাজ্যের অধিপতি হলেও তিনি সমগ্র বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি । পূর্ববঙ্গে লক্ষণ সেনের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল । মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা আরও কিছুদিন পূর্ববঙ্গ শাসন করেছিলেন।
গৌড় বা লখনৌতি বিজয়ের দুই বছর পর বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানে বের হন। এ তিব্বত অভিযানই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সমর অভিযান। কিন্তু তাঁর এ অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি দেবকোটে ফিরে আসেন । সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। অনুমান করা হয় আলি মর্দান নামে একজন আমির তাকে হত্যা করেছিল।
বাংলায় মুসলমান শাসনের ইতিহাসে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই এদেশে প্রথম মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । এ শাসন প্রায় সাড়ে পাঁচশ' বছরের অধিক স্থায়ী হয়েছিল (১২০৪-১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ)। রাজ্য জয় করেই বখতিয়ার খলজি ক্ষান্ত ছিলেন না । বিজিত অঞ্চলে তাঁর শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যও তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন । ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সংস্কৃতি বিকাশের জন্য তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য । তাঁর শাসনকালে বহু মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ।
বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন বখতিয়ার খলজি । এ পর্বের প্রথম পর্যায় ছিল ১২০৪ থেকে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । এ যুগের শাসনকর্তাদের পুরোপুরি স্বাধীন বলা যাবে না। তাঁদের কেউ ছিলেন বখতিয়ারের সহযোদ্ধা খলজি মালিক, আবার কেউ কেউ তুর্কি বংশের শাসক । শাসকদের সকলেই দিল্লির সুলতানদের অধীনে বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন । পরবর্তীকালে অনেক শাসনকর্তাই দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হতে চেয়েছেন । তবে তাঁদের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি । দিল্লির আক্রমণের মুখে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে । মুসলিম শাসনের এ যুগ ছিল বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ । তাই ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী বাংলাদেশের নাম দিয়েছিলেন 'বুলগাকপুর' । এর অর্থ ‘বিদ্রোহের নগরী' ।
বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব । তাঁর সহযোদ্ধা তিনজন খলজি মালিকের নাম জানা যায় । তাঁরা হচ্ছেন- মুহম্মদ শিরান খলজি, আলি মর্দান খলজি এবং হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি । অনেকেরই ধারণা ছিল আলী মর্দান খলজি বখতিয়ার খলজির হত্যাকারী। এ কারণে খলজি আমির ও সৈন্যরা তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেন মুহম্মদ শিরান খলজিকে । তিনি কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। আলি মর্দান খলজিকে বন্দী করা হয় । পরে আলি মর্দান পালিয়ে যান এবং দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিনের সহযোগিতা লাভ করেন । শিরান খলজির শাসনকাল মাত্র এক বছর স্থায়ী ছিল। এরপর ১২০৮ খ্রিষ্টাব্দে দেবকোটের শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি । দিল্লির সহযোগিতায় দুই বছর পর ফিরে আসেন আলি মর্দান খলজি । ইওজ খলজি স্বেচ্ছায় তাঁর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন । আলি মর্দান খলজি ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজের নাম নেন আলাউদ্দিন আলি মদান খলজি । খুব কঠোর শাসক ছিলেন তিনি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমে বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। খলজি মালিকরা একজোট হয়ে বিদ্রোহ করে । তাঁদের হাতে নিহত হন আলি মর্দান খলজি । ইওজ খলজি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসেন । তিনি এ পর্যায়ে গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করেন। ১২১২ থেকে ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর তিনি বাংলার সুলতান ছিলেন ।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নিঃসন্দেহে খলজি মালিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। বখতিয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলার মুসলমান রাজ্যকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজধানী দেবকোট থেকে গৌড় বা লখনৌতিতে স্থানান্তর করেন। রাজধানীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বসনকোট নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়। লখনৌতি নদীতীরে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসা- বাণিজ্যের সুবিধা ছিল । তাছাড়া ইওজ খলজি বুঝতে পেরেছিলেন যে শক্তিশালী, নৌবাহিনী ছাড়া শুধু অশ্বারোহী বাহিনীর পক্ষে নদীমাতৃক বাংলায় রাজ্য সম্প্রসারণ সম্ভব হবে না। বাংলার শাসন বজায় রাখতে হলেও নৌবাহিনীর প্রয়োজন ছিল । তাই বলা যায় যে, বাংলায় মুসলমান শাসকদের মধ্যে ইওজ খলজিই নৌবাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন । রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য এর তিন পাশে গভীর ও প্রশস্ত পরিখা নির্মাণ করা হয় । বার্ষিক বন্যার হাত থেকে লখনৌতি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য তিনি বহু খাল খনন ও সেতু নির্মাণ করেন। তিনি রাস্তা নির্মাণ করে সৈন্য ও পণ্য চলাচলের সুবন্দোবস্ত করেন । এ রাজপথ নির্মাণের ফলে রাজ্য শাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরই শুধু সুবিধা হয়নি, বরং দেশের লোকের নিকট আশীর্বাদস্বরূপও ছিল । কারণ, তা বার্ষিক বন্যার কবল থেকে তাদের গৃহ ও শস্যক্ষেত্র রক্ষা করত ।
উপরে উল্লেখিত কার্যাবলি গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজিকে একজন সুশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে । তিনি রাজ্য বিস্তারের দিকেও মনোনিবেশ করেন । পার্শ্ববর্তী হিন্দু, যেমন কামরূপ, উড়িষ্যা, বঙ্গ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) এবং ত্রিহুতের রাজারা তাঁর নিকট কর পাঠাতে বাধ্য হয়। আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসিরের নিকট থেকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি স্বীকৃতিপত্র লাভ করেছিলেন ।
দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির অধীনে লখনৌতির (বাংলা) মুসলমান রাজ্যের প্রতিপত্তি বিস্তার কখনও ভালো চোখে দেখেননি। কিন্তু রাজত্বের প্রারম্ভে আশু বিপদ ও সমস্যার সমাধান করার পূর্বে বাংলার দিকে নজর দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি । ১২২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিপদসমূহ দূর হলে সুলতান ইলতুৎমিশ বাংলার দিকে দৃষ্টি দেন । ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে মুঙ্গের কিংবা শকরিগলি গিরিপর্বতের নিকট উভয় দলের সৈন্য মুখোমুখি হলে ইওজ খলজি সন্ধির প্রস্তাব করেন। উভয়পক্ষে সন্ধি হয়। ইলতুৎমিশ খুশি হয়ে মালিক আলাউদ্দিন জানিকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং ইওজ খলজিকে বঙ্গের শাসক পদে বহাল রে
খে দিল্লিতে ফিরে যান । কিন্তু সুলতান দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইওজ খলজি পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । বিহার আক্রমণ করে সেখানকার শাসনকর্তা আলাউদ্দিন জানিকে বিতাড়ন করা হয়।
ইওজ খলজি লখনৌতি ফিরে এসেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইলতুৎমিশ আবার বাংলা আক্রমণ করবেন । তিনি প্রায় এক বছরকাল প্রস্তুতি নিয়ে রাজধানীতে অবস্থান করেন এবং পাল্টা আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করেন । এ সময় দিল্লির রাজকীয় বাহিনী অযোধ্যার বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইওজ খলজি মনে করলেন এ অবস্থায় দিল্লি বাহিনীর পক্ষে বাংলা আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি এ অবসরে পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করার মনস্থ করেন। রাজধানী লখনৌতি একপ্রকার অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। এদিকে, সুলতান ইলতুৎমিশ পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে লখনৌতি আক্রমণের নির্দেশ দেন। ইওজ খলজির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বঙ্গের রাজধানী লখনৌতি আক্রমণ করেন। এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইওজ খলজি অতি অল্প সংখ্যক সৈন্য সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন । শত্রুবাহিনী পূর্বেই তাঁর বসনকোট দুর্গ অধিকার করেছিল । যুদ্ধে ইওজ খলজি পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয় । ইওজ খলজির পরাজয় ও পতনের ফলে বঙ্গদেশ পুরোপুরিভাবে দিল্লির সুলতানের অধিকারে আসে। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বঙ্গদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন ।
ইওজ খলজি শিল্প ও সাহিত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ের জুমা মসজিদ এবং আরও কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তাঁর আমলে মধ্য এশিয়া থেকে বহু মুসলিম সুফি ও সৈয়দ তাঁর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সমস্ত সুফি ও সুধীগণ বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করেন । তাঁদের আগমন ও ইওজ খলজির পৃষ্ঠপোষকতায় লখনৌতি মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইওজ খলজির মৃত্যুর পর থেকে ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ষাট বছর বাংলা দিল্লির মুসলমান শাসকদের একটি প্রদেশে পরিগণিত হয় । এ সময় পনেরো জন শাসনকর্তা বাংলা শাসন করেন। তাঁদের দশজন ছিলেন দাস। দাসদের ‘মামলুক' বলা হয়। এ কারণে ষাট বছরের বাংলার শাসনকে অনেকে দাস শাসন বা মামলুক শাসন বলে অভিহিত করেন । কিন্তু এ যুগের পনেরোজন শাসকের সকলেই তুর্কি বংশের ছিলেন । তুর্কি শাসকদের সময়ে দিল্লিতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ চলছিল । সুতরাং বাংলার মতো দূরবর্তী প্রদেশের দিকে সুলতানদের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। পরিণামে বাংলার তুর্কি শাসকরা অনেকটা স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতেন । ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে অল্প সময়ের জন্য বাংলায় ক্ষমতায় বসেন দওলত শাহ-বিন-মওদুদ। বাংলার অর্থাৎ লখনৌতির প্রথম তুর্কি শাসনকর্তা ছিলেন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ । তিনি ছিলেন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র । ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশের মৃত্যু হলে দিল্লিতে গোলযোগ দেখা যায় । এ সুযোগে আওর খান আইবক লখনৌতির ক্ষমতা দখল করে নেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই বিহারের শাসনকর্তা তুঘরল তুঘান খানের হাতে তাঁর পরাজয় ঘটে । তুঘান খান ১২৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নয় বছর বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন । এরপর দুই বছরের জন্য লখনৌতির ক্ষমতায় বসেন ওমর খান ।
১২৪৭ থেকে ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন জালালউদ্দিন মাসুদ জানি। তিনি লখনৌতিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন । পরবর্তী শাসক ছিলেন অযোধ্যার শাসনকর্তা মালিক ইজ্জউদ্দিন বলবন-ই- ইউজবকী যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করার পর মাসুদ জানি ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে 'মুঘিসউদ্দিন' উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । তিনি ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিহত হন । পরবর্তী দুই বছর লখনৌতি স্বাধীনভাবে শাসন করেন মালিক মালিক ইজ্জউদ্দিন বলবন-ই- ইউজবকী । পরে ১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কারা প্রদেশের শাসনকর্তা তাজউদ্দিন আরসালান খান লখনৌতির সিংহাসনে বসেন। আরসালান খানের পর বাংলার শাসনকর্তা হন তাতার খান। তিনি দিল্লির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও কয়েক বছরের মধ্যে দিল্লির সাথে বাংলার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তাতার খানের পর অল্পদিনের জন্য বাংলার ক্ষমতার বসেছিলেন শের খান ।
পরবর্তী শাসনকর্তা তুঘরিল ছিলেন মামলুক তুর্কিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। উত্তর এবং পশ্চিম বাংলা ছাড়াও ঢাকা এবং ফরিদপুরের বেশ কিছু অঞ্চল তিনি অধিকারে আনেন। সোনারগাঁয়ের নিকট তিনি নারকেল্লা নামে এক দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গটি তুঘরিলের কেল্লা নামে পরিচিত ছিল । তুঘরিল ‘মুঘিসউদ্দিন' উপাধি নিয়ে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে দিল্লির সুলতান বলবন এ বিদ্রোহের শাস্তি দিতে বাংলা আক্রমণ করেন । ১২৮১ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন তুঘরিল । বাংলার শাসনকর্তারা বিদ্রোহ করেন এ কারণে বলবন তাঁর ছেলে বুঘরা খানকে বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন । পরবর্তী ছয় বছর বাংলা দিল্লির অধীনে ছিল। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান ‘নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ' নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। এ সময় দিল্লির সুলতান ছিলেন বুঘরা খানের ছেলে কায়কোবাদ ।
কায়কোবাদের মৃত্যুসংবাদে বুঘরা খানের মন ভেঙে যায়। তিনি তাঁর অন্য পুত্র রুকনউদ্দিন কায়কাউসকে বাংলার সিংহাসনে বসিয়ে নিজে সরে যান । কায়কাউস (১২৯১-১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ) দশ বছর বাংলার শাসক ছিলেন। তাঁর কোনো ছেলে না থাকায় পরবর্তী শাসনকর্তা হন মালিক ফিরুজ ইতগিন । তিনি সুলতান হিসেবে নতুন নাম ধারণ করেন ‘সুলতান শামসুদ্দিন ফিরুজ শাহ'। ফিরুজ শাহের মৃত্যু হলে পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। অল্পকাল পরেই দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের হাতে তিনি পরাজিত ও বন্দী হন। এরপর থেকে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা দিল্লির অধীনে ছিল ।
দিল্লির সুলতানগণ ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুইশ' বছর বাংলাকে তাঁদের অধিকারে রাখতে পারেন নি। প্রথমদিকে দিল্লির সুলতানের সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে বাংলাকে নিজের অধিকারে আনার জন্য । অবশেষে সফল হতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে । তাই, এ সময়ে বাংলার সুলতানগণ স্বাধীনভাবে এবং নিশ্চিন্তে এদেশ শাসন করতে পেরেছেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতানদের হাতে বাংলা প্রথম স্থিতিশীলতা লাভ করে ।
স্বাধীন সুলতানি আমল (১৩৩৮- ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ ):
১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যু হয়। বাহরাম খানের বর্মরক্ষক ছিলেন 'ফখরা’ নামের একজন রাজকর্মচারী। প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং 'ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ' নাম নিয়ে সোনারগাঁয়ের সিংহাসনে বসেন। এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের । দিল্লির মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের এ সময় বাংলার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ ছিল না । তাই, সোনারগাঁয়ে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীন অঞ্চলের সীমা বিস্তৃত হতে থাকে। পরবর্তী দুইশ' বছর এ স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি । দিল্লির শাসনকর্তাগণ সোনারগাঁয়ের ফখরুদ্দিনের স্বাধীনতা ঘোষণাকে সুনজরে দেখেননি । তাই, দিল্লির প্রতিনিধি লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দিন মিলিতভাবে সোনারগাঁ আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেনি। কদর খান ফখরুদ্দিনের সৈন্যদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে ফখরুদ্দিন নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন । তাঁর মুদ্রায় খোদিত তারিখ দেখে ধারণা করা যায়, তিনি ১৩৩৮ থেকে ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন । ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাঁর রাজসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিছুটা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন । তিনি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ তৈরি করিয়েছিলেন বলে জানা যায় । ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁ টাকশাল থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজি শাহ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করা হয়। গাজি শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রায় ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তারিখ পাওয়া যায় । সুতরাং বোঝা যায়, ফখরুদ্দিনপুত্র গাজি শাহ পিতার মৃত্যুর পর সোনারগাঁয়ের স্বাধীন সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর রাজত্ব করেন ।
ইলিয়াস শাহি বংশ:
সোনারগাঁয়ে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ যখন স্বাধীন সুলতান তখন লখনৌতির সিংহাসন দখল করেছিলেন সেখানকার সেনাপতি আলি মুবারক । সিংহাসনে বসে তিনি 'আলাউদ্দিন আলি শাহ' উপাধি গ্রহণ করেন। লখনৌতিতে তিনিও স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন । পরে রাজধানী স্থানান্তর করেন পাণ্ডুয়ায় (ফিরোজাবাদ)। আলি শাহ ক্ষমতায় ছিলেন ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । তাঁর দুধভাই ছিলেন হাজি ইলিয়াস। তিনি আলি শাহকে পরাজিত ও নিহত করে ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ' নাম নিয়ে বাংলায় একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন । এই রাজবংশের নাম ইলিয়াস শাহি বংশ । এরপর ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ অনেক দিন বাংলা শাসন করেন । মাঝখানে কিছুদিনের জন্য হিন্দু রাজত্বের উত্থান ঘটেছিল ।
১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজাবাদের সিংহাসন অধিকারের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলার অধিপতি হন । সোনারগাঁ ও সাতগাঁও তখনও তাঁর শাসনের বাইরে ছিল। ইলিয়াস শাহের স্বপ্ন ছিল সমগ্র বাংলার অধিপতি হওয়া। তিনি প্রথম দৃষ্টি দেন পশ্চিম বাংলার দিকে । ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে সাতগাঁও তাঁর অধিকারে আসে । ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে নেপাল আক্রমণ করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন । এ সময় তিনি ত্রিহুত বা উত্তর বিহারের কিছু অংশ জয় করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন। উড়িষ্যাও তাঁর অধিকারে আসে। তবে ইলিয়াস শাহের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল পূর্ব বাংলা অধিকার ।
ইখতিয়ার উদ্দিন গাজি শাহ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁয়ে ইলিয়াস শাহের হাতে পরাজিত হন। সোনারগাঁ দখলের মাধ্যমে সমগ্র বাংলার অধিকার সম্পন্ন হয় । তাই বলা হয়, ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতার সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে । বাংলার বাইরেও বিহারের কিছু অংশ— চম্পারণ, গোরক্ষপুর এবং কাশী ইলিয়াস শাহ জয় করেছিলেন । কামরূপের কিছু অংশও তিনি জয় করেন । মোটকথা, তাঁর রাজ্যসীমা আসাম থেকে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । ইলিয়াস শাহ দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করায় সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন ।
প্রথম দিকে দিল্লির সুলতান বাংলার এ স্বাধীনতা মেনে নেননি । সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক ১৩৫৩ থেকে ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন । তাঁর চেষ্টা ছিল বাংলাকে দিল্লির অধিকারে নিয়ে আসা । কিন্তু তিনি সফল হননি । ইলিয়াস শাহ দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে বর্ষা এলে জয়ের কোনো সম্ভাবনা না থাকায়, ফিরোজ শাহ সন্ধির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে ইলিয়াস শাহের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিল্লি ফিরে যান ।
শাসক হিসেবে ইলিয়াস শাহ ছিলেন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয় । তাঁর শাসনামলে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল । হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। হাজিপুর নামক একটি শহর তিনি নির্মাণ করেছিলেন। ফিরোজাবাদের বিরাট হাম্বামখানা তিনিই নির্মাণ করেন। এ আমলে স্থাপত্য শিল্প ও সংস্কৃতি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল । তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন । তিনি ফকির-দরবেশদের খুব শ্রদ্ধা করতেন। ইলিয়াস শাহ লখনৌতির শাসক হিসেবে বঙ্গ অধিকার করলেও দুই ভূখণ্ডকে একত্রিত করে বৃহত্তর বাংলার সৃষ্টি করেছিলেন । এ সময় থেকেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসী 'বাঙালি' বলে পরিচিত হয়। ইলিয়াস শাহ 'শাহ-ই বাঙ্গালা' ও 'শাহ-ই-বাঙালিয়ান' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন ।
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সিংহাসনে বসেন । পিতার মতো তিনিও দক্ষ এবং শক্তিশালী শাসক ছিলেন। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৮ থেকে ১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও ফিরোজ শাহ তুঘলককে ব্যর্থ হতে হয় । পিতার মতো সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধির মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে । সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জাফর খানকে সোনারগাঁয়ের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয় । কিন্তু জাফর খান এ পদ গ্রহণে রাজি হলেন না। ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে তিনিও দিল্লিতে ফিরে গেলেন । সোনারগাঁ এবং লখনৌতিতে আবার আগের মতোই সিকান্দার শাহের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রইল । ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিকান্দার শাহ সেভাবেই একে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করতে সক্ষম হন ।
সুলতান সিকান্দার শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন ‘আজম শাহ' (১৩৯৩-১৪১১ খ্রিষ্টাব্দ) উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন । ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহ যুদ্ধবিগ্রহ ও স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের কৃতিত্ব ছিল অন্যত্র । তিনি তাঁর প্রজারঞ্জক ব্যক্তিত্বের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি তাঁর রাজত্বকালে আসামে বিফল অভিযান প্রেরণ করেন । জৌনপুরের রাজা খান জাহানের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেন । চীনা সম্রাট ইয়াংলো তাঁর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন । তিনিও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে চীনা সম্রাটের নিকট মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করেন । মোটকথা, আযম শাহ কোনো যুদ্ধে না জড়ালেও পিতা এবং পিতামহের গড়া বিশাল রাজত্বকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন । সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন। রিয়াজ-উস- সালাতিন গ্রন্থে তাঁর ন্যায় বিচারের এক অতি উজ্জ্বল কাহিনির বর্ণনা আছে ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। কবি-সাহিত্যিকগণকে তিনি সমাদর ও শ্রদ্ধা করতেন । তিনি কাব্যরসিক ছিলেন এবং নিজেও ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন । পারস্যের প্রখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ হতো ।
মুসলমান শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ বঙ্গের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর রাজত্বকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জুলেখা' কাব্য রচনা করেন । আযম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সুফি সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পাণ্ডুয়ায় আস্তানা গড়ে তোলেন। ফলে পাণ্ডুয়া ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল । সুলতান মক্কা ও মদিনাতেও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ছিলেন বঙ্গের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম এবং ইলিয়াস শাহি বংশের শেষ সুলতান । তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এ বংশের পতন শুরু হয় ।
রাজা গণেশ ও হাবসি শাসন:
সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, বাংলার ইতিহাসের দুইশ' বছর (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) মুসলমান সুলতানদের স্বাধীন রাজত্বের যুগ। তথাপি এই দুইশ' বছরের মাঝামাঝি অল্প সময়ের জন্য কিছুটা বিরতি ছিল। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফুদ্দিন হামজা শাহ সিংহাসনে বসেন । কিন্তু এ সময় অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতা দখল নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে । তিনি এক বছর শাসন করার পর ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ক্রীতদাস শিহাব উদ্দিনের হাতে নিহত হন । শিহাব উদ্দিন সুলতান হয়ে নিজের নাম নেন শিহাব উদ্দিন বায়াজিদ শাহ'। কিন্তু দুই বছরের মাথায় ১৪১৪-১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনিও ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন । এ সুযোগে হিন্দু অভিজাত রাজা গণেশ বাংলার ক্ষমতা দখল করেন ।
বাংলার সুলতানরা অনেক উচ্চপদেই হিন্দুদের নিয়োগ করতেন । আজম শাহের একজন উচ্চপদস্থ অমাত্য ছিলেন রাজা গণেশ । জানা যায় গণেশ প্রথমে দিনাজপুরের ভাতুলিয়া অঞ্চলের একজন রাজা ছিলেন । তিনি সুলতানের দরবারে চাকরি নেন । চাকরি নিয়েই তিনি গোপনে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন । তাঁর ইচ্ছে ছিল মুসলমানদের হটিয়ে পুনরায় হিন্দুশক্তির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যেই তিনি ইলিয়াস শাহি বংশ উচ্ছেদ করে নিজে ক্ষমতায় বসেন। গণেশ অনেক সুফি সাধককে হত্যা করেন। মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য দরবেশদের নেতা নূর কুতুব-উল-আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির নিকট আবেদন জানান । ইব্রাহিম শর্কি সসৈন্যে বাংলায় উপস্থিত হলে গণেশ ভয় পেয়ে যান। অবশেষে, তিনি আপোস করেন দরবেশ নূর কুতুব-উল-আলমের সাথে । শর্ত অনুযায়ী গণেশ তাঁর ছেলে যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং ছেলের হাতে বাংলার সিংহাসন ছেড়ে দেন। মুসলমান হওয়ার পর যদুর নাম হয় জালালউদ্দিন মাহমুদ । সুলতান ইব্রাহিম শর্কি জালালউদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে ফিরে যান নিজ দেশ জৌনপুরে।
গণেশ দুইবার সিংহাসনে বসেছিলেন। প্রথমবার কয়েক মাস মাত্র ক্ষমতায় ছিলেন। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি ইব্রাহিম শর্কি জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। ইব্রাহিম শর্কি ফিরে গেলে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন গণেশ । তখন জালালউদ্দিনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করেন । অনেক আচার-অনুষ্ঠান করিয়ে ছেলেকে আবার হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন। গণেশ ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন । রাজা গণেশের মৃত্যুর পর হিন্দু আমাত্যগণ গণেশের পুত্র মহেন্দ্রদেবকে বঙ্গে সিংহাসনে বসান । কিন্তু অতি অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে জালালউদ্দিন দ্বিতীয়বার বঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন । এ পর্যায়ে তিনি একটানা ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এ সুযোগ্য শাসকের সময় বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায় । প্রায় সমগ্র বাংলা এবং আরাকান ব্যতীত ত্রিপুরা ও দক্ষিণ বিহারেরও কিছু অংশ সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন টাকশাল থেকে তাঁর নামে মুদ্ৰা প্ৰকাশিত হয়েছিল । পাণ্ডুয়া থেকে তিনি গৌড়ে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন ।
জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন । ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আহমদ শাহ অমাত্যবর্গের ষড়যন্ত্রে সাদি খান ও নাসির খান নামক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন । এভাবে রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধরদের প্রায় ত্রিশ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটে ।
পরবর্তী ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন:
শামসুদ্দিন আহমদ শাহের মৃত্যুর পর তার হত্যাকারী ক্রীতদাস নাসির খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু আহমদ শাহকে হত্যা করার ব্যাপারে যে অভিজাতবর্গ ইন্ধন দেয়, তারা নাসির খানের সিংহাসনে আরোহণকে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেনি । সম্ভবত ক্রীতদাসের আধিপত্যকে তারা অপমানজনক মনে করেছিল । তাই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাসির খানকে হত্যা করে ।
নাসির খান নিহত হওয়ার পর গৌড়ের সিংহাসন কিছু সময়ের জন্য শূন্য অবস্থায় পড়ে রইল । আহমদ শাহের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। অতঃপর অভিজাতবর্গ মাহমুদ নামে ইলিয়াস শাহের এক বংশধরকে ১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সিংহাসনে বসায় । ইতিহাসে তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ নামে পরিচিত । ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ এভাবে পুনরায় স্বাধীন রাজত্ব শুরু করেন। তাই এ যুগকে বলা হয় ‘পরবর্তী ইলিয়াস শাহি যুগ” । নাসিরউদ্দিন একজন দক্ষ সেনাপতি ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। যশোর ও খুলনা অঞ্চল নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে মুসলমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল । পশ্চিম বঙ্গ, পূর্ব বঙ্গ, উত্তর বঙ্গ ও বিহারের কতকাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । তিনি নিজ নামে মুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন।
১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ মৃত্যুবরণ করেন । এরপর তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন বরবক শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার রাজত্বকাল থেকেই বরবক শাহ শাসক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন সাতগাঁওয়ের শাসনকর্তা । তাঁর রাজত্বকালে বাংলার রাজ্যসীমা অনেক বৃদ্ধি পায় ৷ গঙ্গা নদীর উত্তরাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । ভাগলপুর তাঁর শাসনকালে মুসলমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নিয়ে গোলযোগ ছিল । বরবক শাহের রাজত্বকালের প্রথম দিকে এটি আরাকান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল । কিন্তু শেষ দিকে বরবক শাহ তা পুনরুদ্ধার করেন। যশোর ও খুলনা তাঁর অধিকারে ছিল। তিনি দক্ষিণ দিকেও তাঁর রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন ।
বরবক শাহই প্রথম অসংখ্য আবিসিনীয় ক্রীতদাস (হাবসি ক্রীতদাস) সংগ্রহ করে সেনাবাহিনী ও রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন । নিয়োগকৃত এ হাবসি ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল আট হাজার । তিনি সম্ভবত রাজ্যে একটি নিজস্ব দল গঠনের উদ্দেশ্যে এই হাবসিদের নিয়ে বাহিনী গঠন করেছিলেন । কিন্তু তাঁর এ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনে। সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহ একজন মহাপণ্ডিত ছিলেন । বিভিন্ন শিলালিপিতে তাঁর নামের পাশে নিজ নামে এবং বিভিন্ন রাজকীয় ‘আল-ফাজিল' ও 'আল-কামিল' এ দুইটি উপাধির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বরবক শাহ শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি শুধু পণ্ডিতই ছিলেন না, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মেরই বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তিনি যে একজন উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনের নরপতি ছিলেন তা হিন্দু কবি-পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা ও বহু হিন্দুকে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করা থেকে বুঝা যায়। এদিক দিয়ে বরবক শাহের মতো উদার মনোভাবাপন্ন শাসক শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসেও দুর্লভ ।
বরবক শাহ একজন প্রকৃত সৌন্দর্যরসিক ছিলেন । গৌড়ের ‘দাখিল দরওয়াজা' নামে পরিচিত বিরাট ও সুন্দর তোরণটি বরবক শাহই নির্মাণ করিয়েছিলেন। এ আমলে চট্টগ্রাম এবং পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জে দুইটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এ সমস্ত কার্যক্রম বিবেচনা করলে বঙ্গের সুলতানদের মধ্যে বরবক শাহকে অন্যতম বলা যায় ৷
১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বরবক শাহ পরলোকগমন করেন। পরে তাঁর পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সুলতান হন । পিতা ও পিতামহের গড়া বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর সময় অক্ষুণ্ণ ছিল । তাঁর রাজ্য পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং পূর্বে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।
ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ সিংহাসনে বসেন । কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে অপসারণ করা হয় । বরবক শাহের ছোট ভাই হুসাইন 'জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি নিজ নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন । কিন্তু এ সময় রাজদরবারে দুর্যোগ দেখা দেয় । হাবসি ক্রীতদাসরা এ সময় খুব ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে । তাদের প্রতিপত্তি কমানোর জন্য জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ চেষ্টা করেন। এতে সমস্ত হাবসি ক্রীতদাস একজোট হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সুলতান শাহজাদা ছিলেন প্রাসাদরক্ষী দলের প্রধান। ক্রীতদাসরা প্রলোভন দ্বারা সুলতান শাহজাদা ও তার অধীনস্থ পাইকদের নিজ দলভুক্ত করে । শাহজাদা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে ফতেহ শাহকে হত্যা করেন। ফতেহ শাহ নিহত হলে বাংলার সিংহাসনে ইলিয়াস শাহি বংশের শাসনকালের পরিসমাপ্তি ঘটে । বাংলায় হাবসিদের রাজত্বের সূচনা হয় ।
হাবসি শাসন:
বাংলায় হাবসি শাসন মাত্র ছয় বছর (১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ ) স্থায়ী ছিল। এ সময় এদেশের ইতিহাস ছিল অন্যায়, অবিচার, বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র আর হতাশায় পরিপূর্ণ । এ সময়ে চারজন হাবসি সুলতানের মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করা হয় । হাবসি নেতা সুলতান শাহজাদা ‘বরবক শাহ' উপাধি নিয়ে প্রথম বাংলার ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হাবসি সেনাপতি মালিক আন্দিলের হাতে নিহত হন। মালিক আন্দিল ‘সাইফুদ্দিন ফিরুজ শাহ' উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন । একমাত্র তাঁর তিন বছরের রাজত্বকালের (১৪৮৭-১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দ) ইতিহাসই কিছুটা গৌরবময় ছিল । তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ । কিন্তু কিছুকাল (১৪৯০-১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করার পরই তিনি নিহত হন । এক হাবসি সর্দার তাঁকে হত্যা করে “শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ' নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন (১৪৯১-১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ)। অত্যাচারী ও হত্যাকারী হিসেবে তার কুখ্যাতি ছিল । ফলে গৌড়ের সম্ভ্রান্ত লোকেরা মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে । বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেন মুজাফফর শাহের উজির সৈয়দ হোসেন। অবশেষে মুজাফফর শাহ নিহত হন । তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় হাবসি শাসনের অবসান ঘটে ।
হুসেন শাহি বংশ:
হাবসি শাসন উচ্ছেদ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন সৈয়দ হুসেন। সুলতান হয়ে তিনি ‘আলাউদ্দিন হুসেন শাহ' উপাধি গ্রহণ করেন । এভাবেই বাংলায় 'হুসেন শাহি বংশ' নামে এক নতুন বংশের শাসনপর্ব শুরু হয় । বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে হুসেন শাহি আমল (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) ছিল সবচেয়ে গৌরবময় । সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন হুসেন শাহি যুগের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি আরব দেশীয় সৈয়দ বংশের লোক ছিলেন। পিতা সৈয়দ আশরাফ-আল-হুসাইনি ও ভাই ইউসুফের সাথে তিনি মক্কা থেকে বাংলায় আসেন এবং রাঢ়ের চাঁদপাড়া গ্রামে প্রথমে বসবাস শুরু করেন । হুসেন শাহ পরে রাজধানী গৌড়ে যান এবং মুজাফফর শাহের অধীনে চাকরি লাভ করেন । পরে তিনি উজির হন । এভাবেই তিনি বাংলার ক্ষমতায় আসেন ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব থেকে সাম্রাজ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল । রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন । হাবসি গোষ্ঠীর দুঃশাসনের ফলে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল । প্রতিটি সুলতানের হত্যার পেছনে তারা প্রধান ভূমিকা পালন করত। সিংহাসন লাভের পর হুসেন শাহ হাবসিদের এরূপ কার্যকলাপ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা তাঁর আদেশ অমান্য করলে তিনি তাদের হত্যার আদেশ দেন। হুসেন শাহের এ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে প্রায় বারো হাজার হাবসি প্রাণ হারায় । বাকি হাবসিরা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল দেহরক্ষী পাইক বাহিনীর ক্ষমতার বিনাশ। এ পাইক বাহিনী রাজপ্রাসাদের সকল ষড়যন্ত্রের মূলে কাজ করত । হুসেন শাহ পাইকদের দল ভেঙে দেন । তাদের জায়গায় সম্ভ্রান্ত হিন্দু ও মুসলমানদের নিয়ে তিনি একটি নতুন রক্ষীদল গঠন করেন ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ রাজ্যের কল্যাণের লক্ষ্যে বঙ্গের রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে হাবসিদের প্রভাবমুক্ত করতে যেমন সচেষ্ট ছিলেন, তেমনি রাজধানী পরিবর্তন করে শাসন ব্যবস্থা দৃঢ় করেন । গৌড় রাজ্যের নিকটবর্তী এক জায়গায় তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। বঙ্গের সুলতানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই পাণ্ডুয়া বা গৌড় ব্যতীত অন্যত্র রাজধানী স্থাপন করেন । হাবসি শাসনকালে গোলযোগ সৃষ্টিকারী আমির-ওমরাহদের কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়। নিচ বংশজাত অত্যাচারী সকল কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয় । তার পরিবর্তে তিনি শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চ পদে সৈয়দ, মোঙ্গল, আফগান, হিন্দুদের নিযুক্ত করেন। এ সব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময় বাংলার রাজ্যসীমা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। তিনি কামরূপ ও কামতা জয় করেন । উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশও তাঁর করায়ত্ত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ বিহারের কিছু অংশও তাঁর অধিকারে আসে । তিনি আরাকানিদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়ন করেন । এ সময়ে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদি বাংলা আক্রমণ করলে তিনি তা প্রতিহত করেন । একমাত্র আসাম অভিযানে তিনি সফল হতে পারেননি । বিশাল রাজ্যে সব রকম নিরাপত্তা বিধানে হুসেন শাহ্ সফল হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ বিশ বছর (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন। এ সুদীর্ঘ সময় সাফল্যের সাথে রাজ্য পরিচালনা করে এ মহান সুলতান ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্, সুশাসক ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। শাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং জনকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি উদ্যম, নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। রাজার রাজ্য জয়ই শেষ কথা নয়, যুগোপযোগী ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থাও যে অপরিহার্য তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। শাসনকার্য পরিচালনা ও প্রজাপালনের ক্ষেত্রে তিনি জাতি ও ধর্মের কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করেননি। হিন্দু মুসলমান-উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপনের যারা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও কল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর লক্ষ্য। এজন্য একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে যোগ্যতা অনুসারে শাসনকার্যে নিয়োগ করেছিলেন। হিন্দুদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি তাদের বিভিন্ন উপাধিও প্রদান করতেন। হিন্দুদের প্রতি হুসেন শাহের এ উদারতা সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে ফলপ্রসু হরেছিল এবং বাঙালিদের নিজ ঐতিহ্য সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল। এটি তাঁর রাজনৈতিক দুরদর্শিতারও পরিচয় বহন করে। হুসেন শাহের এ ধর্মীয় উদারতা তাঁর উত্তরাধিকারীদেরও উৎসাহিত করেছিল। তার শান্তিপূর্ণ রাজত্বকালে প্রজারা সুখে-শান্তিতে ৰাস করত।
হুসেন শাহের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি স্থাপনের প্রচেষ্টা তৎকালীন সমাজ-জীবনকেও প্রভাবিত করেছিল। তাঁর শাসনকালেই আবির্ভাব ঘটে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেবের। হুসেন শাহ তাঁর প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন এবং তাকে ধর্ম প্রচারে সব রকম সহারতা করার জন্য কর্মচারীদের নির্দেশ দেন। সত্যপীরের আরাধনা হুসেন শাহের শাসনকালের আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সত্যপীরের আধা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল প্রচেষ্টা ।
বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশ হলেন শাহের শাসনকালকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছে। হুসেন শাহ যোগ্য কবি ও সাহিত্যিকগণকে উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কার প্রদান করতেন। এ যুগের প্রখ্যাত কবি ও লেখকদের মধ্যে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, মালা বসু, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস, পরাগল খান উল্লেখযোগ্য ছিলেন। হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। করেন। তাদের নিরলস সাহিত্য কীর্তি বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এ সময়ে মালাধর বসু 'শ্রীমদ্ভগবদ' ও 'পুরাণ" এবং পরমেশ্বর 'মহাভারত' বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন । আলাউদ্দিন হুসেন শাহ আরবি ও ফার্সি ভাষারও উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
হুসেন শাহ একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন । নিজ ধর্ম ও সুফি সাধকদের প্রতি তাঁর অপরিসীম নিষ্ঠা ও ভক্তি ছিল । তাঁর রাজত্বকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এ সমস্ত মসজিদের মধ্যে গৌড়ের ‘ছোট সোনামসজিদ' সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। রাজ্যে ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশের জন্য অনেক খানকাহ্ ও মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছিল। পাণ্ডুয়ার মুসলমান সাধক কুতুব-উল-আলমের সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হুসেন শাহ প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন । তিনি গৌড়ে একটি দুর্গ ও তোরণ, মালদহে একটি বিদ্যালয় ও একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। এ সকল মসজিদ, মাদ্রাসা, দুর্গ, তোরণ হুসেন শাহের স্থাপত্যপ্রীতির পরিচয় বহন করে । তাঁর ২৬ বছরের শাসনকালে বঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অভাবিত উন্নতি সাধিত হয়েছিল । এজন্য তাঁর শাসনকালকে বঙ্গের মুসলমান শাসনের ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ' বলা হয় ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নুসরত শাহ ‘নাসিরউদ্দিন আবুল মুজাফফর নুসরত শাহ' (১৫১৯-১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ) উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর দক্ষতা দেখে হুসেন শাহ তাঁর রাজত্বকালেই শাসনকার্যের কিছু কিছু ক্ষমতা নুসরত শাহকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সিংহাসনে বসেও তিনি পিতার মতো দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন। এ সময় সমগ্র বিহার তাঁর অধীনে আসে। তাঁর সময়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় । প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর বাংলা অভিযানের জন্য সৈন্য পাঠান। নুসরত শাহ প্রথমে বাবরের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন । পরে যুদ্ধ শুরু হলে সন্ধি করে বাংলার সিংহাসনকে নিরাপদ রাখেন । ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে নুসরত শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন ।
সুলতান নুসরত শাহ তাঁর সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন। জনগণের প্রতি তিনি ছিলেন সহনশীল এবং সহৃদয় । প্রজাদের পানি কষ্ট নিবারণের জন্য তিনি রাজ্যের বহু স্থানে কূপ ও পুকুর খনন করেছিলেন। বাগেরহাটের ‘মিঠাপুকুর' আজও তাঁর কীর্তি বহন করছে । নুসরত শাহের মানবিক গুণাবলি তাঁকে প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় করে তুলেছিল । হিন্দুরাও তাঁর রাজ্যে সুবিচার লাভ করত । হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি এ সময়ের বৈশিষ্ট্য ছিল । এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিতার কৃতিত্বকে অম্লান রেখেছিলেন ।
নুসরত শাহের শাসনকালের বহু স্থাপত্য-কীর্তি শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার পরিচয় বহন করে । গৌড়ের বিখ্যাত 'কদম রসুল' ভবনের প্রকোষ্ঠে তিনি একটি মঞ্চ নির্মাণ করেন । তাঁর উপর হযরত মুহম্মদের (সা.) পদচিহ্ন সংবলিত একটি কালো কারুকার্য খচিত মর্মর বেদি বসানো হয়। গৌড়ের সুবিখ্যাত ‘বড় সোনামসজিদ' বা 'বারোদুয়ারি মসজিদ' তাঁর আমলের কীর্তি। বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট নগর এবং রাজশাহী জেলার বাঘা নামক স্থানে তিনি দুইটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর কার্যসমূহের আর একটি নিদর্শন হলো সাদুল্লাপুরে মহান আউলিয়া মখদুম আখি সিরাজউদ্দিনের গৌরবময় মাজারের ভিত্তি ।
নুসরত শাহের আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের কিয়দংশ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন । তাঁর শাসনকালেই শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অশ্বমেধপর্বের বঙ্গানুবাদ করেন। শ্রীধরও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। জ্ঞান ও শিক্ষা প্রসারের জন্য নুসরত শাহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাইব্রেরিও স্থাপন করেছিলেন ।
বাংলার পরবর্তী সুলতান ছিলেন নুসরত শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ । তিনি প্রায় এক বছর ক্ষমতায় ছিলেন । নুসরত শাহের সময় থেকেই অহোম রাজ্যের সাথে বাংলার সংঘর্ষ চলছিল । ফিরোজ শাহের সময়ও তা অব্যাহত থাকে । নুসরত শাহের সময়কাল থেকেই শুরু হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের পতন পর্ব । নুসরত শাহের উত্তরাধিগণ ছিলেন দুর্বল । তাঁর ছোট ভাই গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু, তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি । বরং নুসরত শাহের শাসনকালে রাজ্যে যে ভাঙনের সূচনা হয়েছিল, মাহমুদ শাহের শাসনকালে তা সম্পূর্ণ হয় । তাঁর পাঁচ বছরের রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা আফগান নেতা শের শাহ শূরের সাথে সংঘর্ষ । অবশেষে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ গৌড় দখল করলে বাংলার দুইশ' বছরের স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান ঘটে।
১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হলে একে একে বিদেশি শক্তিসমূহ গ্রাস করতে থাকে বাংলাকে । মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছুকাল বাংলার রাজধানীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে আফগান নেতা শের শাহের কাছে পরাজয় মানতে হয় । বাংলা ও বিহার সরাসরি চলে আসে আফগানদের হাতে । আফগানদের দুই শাখা— শূর আফগান ও কররানি আফগানরা বেশ কিছুকাল বাংলা শাসন করেন । শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবর আফগানদের হাত থেকে বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেন । রাজধানী দখল করলেও মুঘলরা বাংলার অভ্যন্তরে অনেক দিন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি । এ সময় বাংলায় অনেক বড় বড় স্বাধীন জমিদার ছিলেন। ‘বারোভূঁইয়া' নামে পরিচিত এ সকল জমিদার মুঘলদের অধিকার মেনে নেননি । সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সুবাদারগণ ‘বারোভূঁইয়াদের দমন করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি । ‘বারভূঁইয়া’দের দমন করা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে ।
আফগান শাসন:
মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুন হুসেন শাহি যুগের শেষ দিক থেকেই চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে মুঘল অধিকারে নিয়ে আসতে। কিন্তু আফগানদের কারণে মুঘলদের এ উদ্দেশ্য প্রথম দিকে সফল হয়নি । আফগান নেতা শের খান শূরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সম্রাট হুমায়ুন। শের খানের পিতা হাসান খান শূর বিহারে অবস্থিত সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি জায়গিরদার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন । এ সময় বিহারের জায়গিরদার জালাল খান নাবালক বলে তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শের খান ।
সমগ্র ভারতের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন ছিল শের খানের । তাই গোপনে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন । এ লক্ষ্যে অল্প সময়ের মধ্যে শের খান শক্তিশালী চুনার দুর্গ ও বিহার অধিকার করেন। তিনি ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দুইবার বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। এবার সতর্ক হন দিল্লির মুঘল সম্রাট হুমায়ুন । তিনি শের খানের পিছু ধাওয়া করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নেন। গৌড়ের চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন এর নামকরণ করেন ‘জান্নাতবাদ'। সম্রাট গৌড়ে ৬ মাস আমোদ-ফুর্তিতে গা ভাসিয়ে দেন । এ সুযোগে নিজের শক্তি বাড়াতে থাকেন শের খান। দিল্লি থেকে খবর আসে হুমায়ুনের সৎভাই হিন্দাল সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্র করছেন । এ খবর পেয়ে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করেন । এ সুযোগ কাজে লাগান শের খান । তিনি ওঁত পেতে থাকেন বক্সারের নিকট চৌসা নাম স্থানে। গঙ্গা নদীর তীরে এ স্থানে হুমায়ুন পৌঁছালে শের খান তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপ্রস্তুত হুমায়ুন পরাজিত হন (১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)।
মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের খান ‘শের শাহ' উপাধি নেন । তিনি নিজেকে বিহারের স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন । এবার বাংলার দিকে দৃষ্টি দেন তিনি । ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল শাসনকর্তা আলী কুলিকে পরাজিত করে তিনি বাংলা দখল করেন । এ বছরই তিনি হুমায়ুনকে কনৌজের নিকট বিলগ্রামের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন । এভাবে দীর্ঘদিন পর বাংলা আবার দিল্লির শাসনে চলে আসে। চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ শের শাহের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । শের শাহ শূর বংশের বলে এ সময়ের বাংলার শাসন ছিল শূর আফগান বংশের শাসন ।
শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ‘ইসলাম খান' নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি আট বছর (১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন । কিন্তু ইসলাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরোজ খানের সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে শূর বংশের মধ্যে দলাদলি শুরু হয় । শের খানের ভাগ্নে মুবারিজ খান ফিরোজ খানকে হত্যা করে ‘মুহম্মদ আদিল' নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন ।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে এ সময় বাংলা বিচ্ছিন্ন ছিল না। তাই ইসলাম খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার আফগান শাসক মুহম্মদ খান শূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । উপাধি ধারণ করেন 'মুহম্মদ শাহ শূর'। এ সময় থেকে পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত বাংলা স্বাধীন ছিল। মুহম্মদ শাহ শূর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ আদিল শাহ শূরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন । তিনি জৌনপুর জয় করে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন । কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি পরাজিত ও নিহত হন ।
মুহম্মদ শাহ শূর নিহত হলে দিল্লির বাদশাহ আদিল শাহ শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । মুহম্মদ শাহের পুত্র খিজির খান তখন এলাহাবাদে অবস্থান করছিলেন । পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ' উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন । কিছুদিন পর তিনি শাহবাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন ।
এ সময় দিল্লির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। শের শাহের বংশধরদের দুর্বলতার সুযোগে মুঘল বাদশাহ হুয়ায়ুন স্বীয় রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন । কিন্তু দিল্লিতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ পেলেন না। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে শূর বংশীয় আফগান নেতৃবৃন্দকে একে একে দমন করার জন্য অগ্রসর হলেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) আদিল শাহের সেনাপতি হিমু মুঘল সৈন্যদের নিকট পরাজিত ও নিহত হন । এতে আদিল শাহ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন । অতঃপর তিনি বাংলার দিকে পলায়ন করেন । পথিমধ্যে সুরজগড়ের নিকটবর্তী ফতেহপুরে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ কর্তৃক এক যুদ্ধে ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আদিল শাহ পরাজিত ও নিহত হন ।
বাংলা বিজয়ী আফগান সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হলে মুঘল সেনাপতি খান -ই-জামান তাঁর গতিরোধ করেন। কূটকুশলী বাহাদুর শাহ খান-ই-জামানের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন । এরপর তিনি বাংলার বাইরে আর কোনো অভিযান চালাননি। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে
তাঁর মৃত্যু হয় ।
গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা জালালউদ্দিন শূর ‘দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন' উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনিও তাঁর ভ্রাতার ন্যায় মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতেন । ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁর একমাত্র পুত্র বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর নাম জানা যায়নি । মাত্র সাত মাস রাজত্ব করার পর তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নামে জনৈক আফগান দলনেতা তাঁকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু তিনিও বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। কররানি বংশের রাজা তাজ খান কররানি গিয়াসউদ্দিনকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ।
তাজ খান কররানি ও সুলায়মান খান কররানি শের শাহের সেনাপতি ছিলেন। কনৌজের যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শের শাহ তাদের দক্ষিণ বিহারে জায়গির প্রদান করেন। ইসলাম শাহের রাজত্বকালে তাজ খান কররানি সেনাপতি ও কূটনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন । ইসলাম শাহের বালকপুত্র ও উত্তরাধিকারী ফিরোজের সময় তাজ খান উজির নিযুক্ত হন । ফিরোজকে হত্যা করে তাঁর মামা মুহম্মদ আদিল শূর সিংহাসনে বসেন। এ সময় তাজ খান কররানি পালিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের সহায়তায় দক্ষিণ বিহারে প্রাধান্য স্থাপন করেন । ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান কররানি নামমাত্র বাংলার সুলতান বাহাদুর শাহ শূরের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে পড়েন ।
বাংলার সিংহাসনের প্রতিও তাঁর দৃষ্টি ছিল । তিনি সুযোগের অন্বেষণে ছিলেন । অজ্ঞাতনামা গিয়াসউদ্দিন যখন শূর বংশের সিংহাসন দখল করেন, তখন সুযোগ বুঝে তাজ খান ও তাঁর ভ্রাতারা গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় দখল করেন। এভাবে তাজ খান কররানি বাংলায় কররানি বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । তাজ খান কররানির মৃত্যুর পর ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভাই সুলায়মান খান কররানি বাংলার সুলতান হন । এ দক্ষ শাসক আফগান নেতাদের তাঁর দলভুক্ত করেন। এভাবে বাংলা ও বিহারের অধিকাংশ এলাকা তাঁর অধিভুক্ত হয় । উড়িষ্যাতেও তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । সোলায়মান কররানির বিজ্ঞ উজির লোদি খানের পরামর্শে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন । তিনি সর্বপ্রথম গৌড় থেকে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তাণ্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে সোলায়মান কররানির মৃত্যু হলে পুত্র বায়জিদ সিংহাসনে বসেন । কিন্তু অল্পকাল পরেই এ অত্যাচারী সুলতানকে হত্যা করেন আফগান সর্দাররা । এবার সিংহাসনে বসেন সোলায়মান কররানির দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কররানি । তিনিই ছিলেন বাংলায় শেষ আফগান শাসক । দাউদ কররানি খুব অদূরদর্শী শাসক ছিলেন । বিশাল রাজ্য ও ধন ঐশ্বর্য দেখে তিনি নিজেকে সম্রাট আকবরের সমকক্ষ ভাবতে থাকেন । এতদিন বাংলা ও বিহারের আফগান শাসকগণ প্রকাশ্যে মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন । কিন্তু দাউদ স্বাধীন সম্রাটের মতো 'বাদশাহ' উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজ নামে খুতবা পাঠ করেন ও মুদ্রা প্রচলন করেন ।
আফগানরা এমনিতেই মুঘলদের শত্রু ছিল । তার ওপর বাংলা-বিহার মুঘলদের অধিকারে না থাকায় সম্রাট আকবরের স্বস্তি ছিল না। দাউদ কররানির স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে আকবর ক্ষুব্ধ হন । প্রথমে আকবর জৌনপুরের শাসনকর্তা মুনিম খানকে নির্দেশ দেন কররানি রাজ্য আক্রমণ করতে । প্রথম দিকে সরাসরি আক্রমণ করেননি মুনিম খান । উজির লোদি খানের সাথে মুনিম খানের বন্ধুত্ব ছিল । দাউদ খান কররানি তাঁর উজির লোদির পরামর্শে মুনিম খানের সাথে ধনরত্ন দিয়ে আপোস করেন । কিন্তু অচিরেই এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। দাউদ খান কিছু ষড়যন্ত্রকারীর পরামর্শে ভুল বোঝেন উজির লোদিকে। দাউদ খানের নির্দেশে হত্যা করা হয় তাঁকে । লোদির বুদ্ধি আর বন্ধুত্বের গুণেই এতদিন মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল বাংলা ও বিহার । তাঁর অনুপস্থিতিতে মুনিম খানের বাংলা ও বিহার আক্রমণে আর বাধা রইল না । মুনিম খান তার বন্ধু লোদির মৃত্যুর পর ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিহার থেকে আফগানদের হটিয়ে দেন । আফগানরা ইতোমধ্যে নিজেদের ভেতর বিবাদ করে দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এ সুযোগে মুনিম খান বাংলার দিকে অগ্রসর হন । কররানিদের বাংলার রাজধানী ছিল তাণ্ডায়। আফগানরা বাংলার রাজধানী তাণ্ডা ছেড়ে পিছু হটে। আশ্রয় নেয় হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে । মুনিম খানের নেতৃত্বে রাজধানী অধিকার করে মুঘল সৈন্যরা ও অগ্রসর হয় সপ্তগ্রামে । দাউদ খান পালিয়ে যান উড়িষ্যায় । মুনিম খান তাণ্ডায় বাংলার মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন । এ সময় তাণ্ডায় প্লেগ রোগ দেখা দিলে মুনিম খানসহ অনেক মুঘল সৈন্য এ রোগে মারা যান। ফলে বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । এ অবস্থার সুযোগে দাউদ কররানি পশ্চিম ও উত্তর বাংলা পুনরায় অধিকার করে নেন । অন্যদিকে ভাটি অঞ্চলের জমিদার ঈসা খান পূর্ব বাংলা থেকে মুঘল সৈন্যদের হটিয়ে দেন। মুঘল সৈন্যরা এবার বাংলা ছেড়ে বিহারে আশ্রয় নেয় ।
মুনিম খানের মৃত্যুসংবাদ আগ্রায় পৌঁছালে সম্রাট আকবর বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠান খানজাহান হুসেন কুলি খানকে । তাঁর সহকারী নিযুক্ত হন রাজা টোডরমল। বাংলায় প্রবেশপথে রাজমহলে মুঘল সৈন্যদের বাধা দেন দাউদ কররানি । মুঘলদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি । ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের নিকট মুঘল ও আফগানদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয় । রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররানির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে । পরে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় । এভাবে বাংলায় কররানি (আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। অবশ্য ‘বারোভূঁইয়া'দের বাধার মুখে মুঘল শাসন বেশি দূর বিস্তৃত হতে পারেনি ।
বারোভূঁইয়াদের ইতিহাস:
সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার ওপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদার মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি । জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। তাঁদের শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী ও নৌবহর ছিল । স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ 'বারোভূঁইয়া' নামে পরিচিত । এ ‘বারো' বলতে বারোজনের সংখ্যা বুঝায় না । ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বোঝাতেই ‘বারো' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ।
বাংলার ইতিহাসে বারোভূঁইয়াদের আবির্ভাব ষোলো শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলোচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাঁরাই ‘বারোভূঁইয়া' । এছাড়াও, বঙ্গদেশে আরও অনেক ছোটখাটো জমিদার ছিলেন। তাঁরাও মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ান । কিন্তু পরে তাঁরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
বারোভূঁইয়াদের ইতিহাস:
সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার ওপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদার মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি । জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। তাঁদের শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী ও নৌবহর ছিল । স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ 'বারোভূঁইয়া' নামে পরিচিত । এ ‘বারো' বলতে বারোজনের সংখ্যা বুঝায় না। ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বোঝাতেই ‘বারো' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ।
বাংলার ইতিহাসে বারোভূঁইয়াদের আবির্ভাব ষোলো শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলোচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাঁরাই ‘বারোভূঁইয়া' । এছাড়াও, বঙ্গদেশে আরও অনেক ছোটখাটো জমিদার ছিলেন। তাঁরাও মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ান । কিন্তু পরে তাঁরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। বারোভূঁইয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন :
বারোভূঁইয়াদের নাম | এলাকার নাম |
ঈসা খান, মুসা খান |
ঢাকা জেলার অর্ধাংশ, প্রায় সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা এবং পাবনা, বগুড়া ও রংপুর জেলার কিছু অংশ । |
চাঁদ রায় ও কেদার রায় |
শ্রীপুর (বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ) |
বাহাদুর গাজি |
ভাওয়াল |
সোনা গাজি |
সরাইল (ত্রিপুরার উত্তর সীমায়) |
ওসমান খান |
বোকাইনগর (সিলেট) |
বীর হামির |
বিষ্ণুপুর (বাকুড়া) |
লক্ষণ মাণিক্য |
ভুলুয়া (নোয়াখালী) |
পরমানন্দ রায় |
চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল) |
বিনোদ রায়,মধু রায় |
চান্দপ্ৰতাপ (মানিকগঞ্জ) |
মুকুন্দরাম, সত্রজিৎ |
ভূষণা (ফরিদপুর) |
রাজা কন্দর্পনারায়ণ,রামচন্দ্র |
বরিশাল জেলার অংশবিশেষ |
প্রথম দিকে বারোভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান । হুসেন শাহি বংশের অবসান হলে ঈসা খানের পিতা সোলায়মান খান সোনারগাঁ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন । খিজিরপুর দুর্গ ছিল তাঁর শক্তির প্রধান কেন্দ্র । সোনারগাঁ ও খিজিরপুরের নিকটবর্তী কাত্রাবু তাঁর রাজধানী ছিল। দাউদ কররানির পতনের পর তিনি সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করেন।
বারোভূঁইয়াদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর বিশেষ মনোযোগ দেন। এজন্য তিনি ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহবাজ খান, ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সাদিক খান, ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে উজির খান ও ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। তাঁরা ঈসা খান ও অন্যান্য জমিদারের সাথে বহুবার যুদ্ধ করেন । কিন্তু বারোভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। তিনি সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারের বিনিময়ে নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘মসনদ-ই-আলা' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন ।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খানের মৃত্যু হলে বারোভূঁইয়াদের নেতা হন তাঁর পুত্র মুসা খান । এদিকে ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহকে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলায় পাঠানো হয় । এবার মানসিংহ কিছুটা সফল হন । ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসা খান এক নৌযুদ্ধে মানসিংহের হাতে পরাজিত হন। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার আগে সম্রাট আকবরের অসুস্থতার খবর আসে। সম্রাটের ডাকে মানসিংহ আগ্রায় ফিরে যান ।
সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর' নাম ধারণ করে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি মানসিংহকে আবার বাংলায় প্রেরণ করেন। এক বছর পর ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব উদ্দিন কোকাকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করা হয় । কুতুব উদ্দিন শের আফকুনের হাতে প্রাণ হারান । তাঁর পরবর্তী সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খান এক বছর পর মারা যান । এর পর ইসলাম খান ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গের সুবাদার নিযুক্ত হন ।
বাংলার বারোভূঁইয়াদের দমন করে এদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের কৃতিত্বপূর্ণ কাজ । আর এ কৃতিত্বের দাবিদার সুবাদার ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে)। শাসনভার গ্রহণ করেই তিনি বুঝতে পারেন যে, বারোভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানকে দমন করতে পারলেই তাঁর পক্ষে অন্যান্য জমিদারকে বশীভূত করা সহজ হবে । সেজন্য তিনি রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । কারণ মুসা খানের ঘাঁটি সোনারগাঁ ঢাকার অদূরে ছিল। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আসার পথে ইসলাম খান কয়েকজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেছিলেন। বারোভূঁইয়াদের মোকাবেলা করার জন্য ইসলাম খান শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন । মুসা খানের সাথে প্রথম সংঘর্ষ বাধে ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে করতোয়া নদীর পূর্বতীরে যাত্রাপুরে । সেখানে মুসা খানের দুর্গ ছিল । যুদ্ধে মুসা খান ও অন্যান্য জমিদার শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন । ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রবেশ করেন । এ সময় থেকে ঢাকা হয় বাংলার রাজধানী । সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর’।
এরপর পুনরায় মুসা খানের নেতৃত্বে মুঘলদের বাধা দেওয়ার জন্য জমিদারদের নৌবহর একত্রিত হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে । ইসলাম খান এর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন স্থানে সৈন্য ও নৌবহর প্রেরণ করেন । ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খানের সঙ্গে জমিদারদের যুদ্ধ শুরু হয়। নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত মুসা খানের কদম রসুল দুর্গসহ অন্যান্য দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে। অবস্থার বিপর্যয়ে মুসা খান সোনারগাঁ চলে আসেন । রাজধানী নিরাপদ নয় মনে করে তিনি মেঘনা নদীতে অবস্থিত ইব্রাহিমপুর দ্বীপে আশ্রয় নেন । মুঘল সৈন্যরা সোনারগাঁ অধিকার করে নেন। এর ফলে জমিদারগণ বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে । কোনো উপায় না দেখে মুসা খানও শেষ পর্যন্ত মুঘলদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হন । ইসলাম খান মুসা খানকে অন্যান্য জমিদারদের মতো মুঘলদের অধীনস্থ জায়গিরের দায়িত্ব দিলেন। এরপর মুসা খান সম্রাটের অনুগত জায়গিরদার হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন । মুসা খানের আত্মসমর্পণে অন্যান্য জামিদার নিরাশ হয়ে মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন । এভাবে বাংলায় বারোভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে ।
সুবাদারি ও নবাবি— এ দুই পর্বে বাংলায় মুঘল শাসন অতিবাহিত হয় । বারোভূঁইয়াদের দমনের পর সমগ্র বাংলায় সুবাদারি প্রতিষ্ঠিত হয় । মুঘল প্রদেশগুলো ‘সুবা' নামে পরিচিত ছিল । বাংলা ছিল মুঘলদের অন্যতম সুবা। সতেরো শতকের প্রথম দিক থেকে আঠারো শতকের শুরু পর্যন্ত ছিল সুবাদারি শাসনের স্বর্ণযুগ । সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর দিল্লির দুর্বল উত্তরাধিকারীদের সময়ে মুঘল শাসন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে বাংলার সুবাদারগণ প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন । মুঘল আমলের এই যুগ ‘নবাবি আমল’ নামে পরিচিত ।
সুবাদারি ও নবাবি আমল:
সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বারোভূঁইয়াদের দমন করে সমগ্র বাংলায় সুবাদারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন সুবাদার বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করেন । তবে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে সুবাদার মীর জুমলা ক্ষমতা গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত কোনো সুবাদারই তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেননি । তাঁদের মধ্যে ইসলাম খান চিশতি (১৬১৭-১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) এবং দিল্লির সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের ভাই ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ (১৬১৭-১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর খুব অল্প সময়ের জন্য সুবাদার নিযুক্ত হন দারার খান, মহব্বত খান, মুকাররম খান এবং ফিতাই খান ।
সম্রাট শাহজাহান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বাংলার সুবাদার হিসেবে কাসিম খান জুয়িনীকে নিয়োগ করেন ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে । হুসেন শাহি যুগ থেকেই বাংলায় পর্তুগিজরা বাণিজ্য করত। এ সময় পর্তুগিজ বণিকদের প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায় । ক্রমে তা বাংলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় । কাসিম খান জুয়িনী শক্ত হাতে পর্তুগিজদের দমন করেন। কাসিম খানের পর সুবাদার ইসলাম খান মাসহানি ( ১৬৩৫-১৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) চার বছর শাসন করেন। অতঃপর শাহজাহান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। সুজা বিশ বছর দায়িত্বে ছিলেন। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল সুজার শাসনকাল। বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর মধ্যে ইংরেজরা এ সময় সুবাদারের কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করছিল। এতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ইংরেজদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের প্রত্যেকেই সম্রাট হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করেন। এ সময় আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই ভাইরের যুদ্ধে ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে শাহ সুজা পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে তিনি আরাকান গমন করেন। সেখানে পরে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে দমন করার জন্য বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত এসেছিলেন। ভাই সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে (১৬৬০-১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব দেন। কুচবিহার এবং আসাম বিজর মীর জুমলার সামরিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর সময়েই কুচবিহার সম্পূর্ণরূপে প্রথমবারের মতো মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। আসাম অভিযানের দ্বারা তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্ত আসাম পর্যন্ত বর্ধিত করেন।
শায়েস্তা খান:
মীর জুমলার মৃত্যুর পর প্রথমে লিলি খান ও পরে দাউদ খান অস্থায়ী সুবাদার হিসেবে বাংলা শাসন করেন । ১৬৬৪ সালে আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। শায়েস্তা খান ছিলেন একজন সুদক্ষ সেনাপতি ও দূরদর্শী শাসক। তিনি মগদের উৎপাত থেকে বাংলার জনগণের জান-মাল রক্ষা করেন। তিনি সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম অধিকার করে আরাকানি জলদস্যুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করেন । সুবাদার শায়েস্তা খান কুচবিহার, কামরূপ, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে মুঘল শাসন সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। সীমায় এলাকার নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর ভয়ে আসামের রাজা মুঘলদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে সাহস পাননি। সুবাদারির শেষ দিকে শায়েস্তা খানের সাথে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ ৰাখে । ইংরেজদের ক্ষমতা এত বৃদ্ধি পেতে থাকে যে, তারা ক্রমে এদেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর শায়েস্তা খান বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। শায়েস্তা খানের পর একে একে খান-ই-জাহান বাহাদুর, ইব্রাহিম খান ও আজিমুদ্দিন বাংলার সুবাদার হন। তাঁদের সময় বাংলার ইতিহাস তেমন ঘটনাবহুল ছিল না।
শায়েস্তা খান তাঁর শাসন আমলে বিভিন্ন জনহিতকর কাজের জন্য স্মরণীয় হরে রয়েছেন। তাঁর সমরে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য সরাইখানা, রাস্তা ও সেতু নির্মিত হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ও কৃষি ক্ষেত্রে তিনি অভাবিত সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। জনকল্যাণকর শাসনকার্যের জন্য শুধু বাংলায় নয়, সম ভারতবর্ষেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার সমরে দ্রব্যমূল্য এত সন্ধা ছিল যে, টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। শায়েস্তা খানের আমলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূলে ছিল শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার। এ আমলে কৃষিকাজের সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসার-বাণিজ্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। শায়েস্তা খান ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদেশি বণিকদের উৎসাহিত করতেন।
শায়েস্তা খানের শাসনকাল বাংলার স্থাপত্য শিল্পের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিচিত্র সৌধমালা, মনোরম সাজে সজ্জিত তৎকালীন ঢাকা নগরী স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের সাক্ষ্য বহন করে। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলায় মুঘলদের 'স্বর্ণযুগ' হিসেবে অভিহিত করা যায় । তাঁর আমলে নির্মিত স্থাপত্য কর্মের মধ্যে ছোট কাটারা, লালবাগ কেল্লা, বিবি পরির সমাধি সৌধ, হোসেনী দালান, সফি খানের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার মসজিদ, চক মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, অন্য কোনো সুবাদার বা শাসনকর্তা ঢাকায় শায়েস্তা খানের মতো নিজের স্মৃতিকে এত বেশি জ্বলন্ত রেখে যেতে পারেননি। বস্তুত ঢাকা ছিল শায়েস্তা খানের নগরী ।
নবাব মুর্শিদকুলি খান:
১৭০০ সালে বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলি খান। তিনি ১৭২৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথমে তাঁকে বাংলার দেওয়ান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় । দেওয়ানের কাজ ছিল সুবার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা। সম্রাট ফররুখ শিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলি খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদ কুলি খান যখন বাংলায় আগমন করেন, তখন বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এ পরিস্থিতির মুখে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বাংলায় মুঘল শাসন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন । স্বীয় ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তিনি বাংলার ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তন করেছিলেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দুর্বল মুঘল সম্রাটগণ দূরবর্তী সুবাগুলোর দিকে তেমন দৃষ্টি দিতে পারেননি । ফলে, এসব অঞ্চলের সুবাদারগণ অনেকটা স্বাধীনভাবে নিজেদের অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। মুর্শিদ কুলি খানও অনেকটা স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি সম্রাটের নামমাত্র আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং বার্ষিক ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাতেন। মুর্শিদ কুলি খানের পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। এভাবে বাংলার সুবাদারি বংশগত হয়ে পড়ে। আর এরই পথ ধরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার স্বাধীন শাসন । নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সময় থেকেই বাংলা সুবা প্রায় স্বাধীন হয়ে পড়ে। এ সময় সুবাকে বলা হতো “নিজামত' আর সুবাদারের বদলে পদবি হয় 'নাজিম'। নাজিম পদটি হয়ে পড়ে বংশগত। সুবাদার বা নাজিমগণ বাংলার সিংহাসনে বসে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে শুধু একটি অনুমোদন নিয়ে নিতেন। তাই, আঠারো শতকের বাংলায় মুঘল শাসনের ইতিহাস নিজামত বা নবাবি আমলরূপে পরিচিত। আর প্রায় স্বাধীন শাসকগণ পরিচিত হন 'নবাব' হিসেবে।
রাজস্ব সংস্কার মুর্শিদ কুলি খানের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি। তিনি ভূমি জরিপ করে রায়তদের সামর্থ্য অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন। রাজস্ব আদায়কে নিশ্চিত ও নিয়মিত করার জন্য তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন । তিনি কর্মচারীদের সাহায্যে ভূমির প্রকৃত উৎপাদিকা শক্তি ও বাণিজ্য করের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতেন। এ পদ্ধতিতে মধ্যস্থ ব্যক্তিদের দ্বারা প্রজাদের হয়রানির কোনো সুযোগ ছিল না । মুর্শিদ কুলি খান দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রসারের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ইংরেজ, ফরাসি ও পারসিক ব্যবসারীদের তিনি উৎসাহ প্রদান করতেন ।ব্যবসায়ীরা যাতে নির্দিষ্ট হারে প্রচলিত কর প্রদান করে এবং তাদের প্রতি যাতে কোনো অবিচার করা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছিল । কলকাতা, চুঁচুড়া ও চন্দননগর বিভিন্ন বিদেশি বণিকদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে ।
সুজাউদ্দিন খান:
মুর্শিদ কুলি খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তাই তাঁর কন্যা জিনাত-উন-নিসার স্বামী সুজাউদ্দিন খানকে ১৭২৭ সালে সম্রাট ফররুখ শিয়ার বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। তিনি ১৭৩৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। সুজাউদ্দিন একজন স্বাধীন নবাবের মর্যাদা নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা-তিন প্রদেশেরই নবাব হয়েছিলেন তিনি। তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বিশ্বাসভাজনদের উচ্চপদ দান করেন। জমিদারদের সাথেও একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন । কিন্তু সুজাউদ্দিনের শেষ জীবন সুখে কাটেনি । প্রাসাদের অনেক কর্মকর্তা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। কিন্তু দক্ষ হাতে তিনি সংকট মোকাবিলা করেন। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হন । তাঁর অযোগ্যতার কারণে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । এ সুযোগে বিহারের নায়েব-ই-নাজিম আলিবর্দি খান সরফরাজকে আক্রমণ করেন। সরফরাজ পরাজিত ও নিহত হন ।
আলিবর্দি খান:
মুঘল সম্রাটের অনুমোদনে নয়, বরং বাহুবলে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন আলিবর্দি খান। আলিবর্দি খানের শাসনকালে (১৭৪০-১৭৫৬ সাল) বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকদিন ধরেই বর্গি নামে পরিচিত মারাঠি দস্যুরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল । আলিবর্দি খান ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছর প্রতিরোধ করে বর্গিদের দেশছাড়া করতে সক্ষম হন। তাঁর শাসনকালে আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করলে তিনি শক্ত হাতে তা দমন করেন । আলিবর্দির সময়ে ইংরেজসহ অনেক ইউরোপীয় বণিকের বাণিজ্যিক তৎপরতা বাংলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। একই সাথে তাঁরা সামরিক শক্তিও সঞ্চয় করতে থাকে। আলিবর্দি খান শক্ত হাতে বণিকদের তৎপরতা রোধ করেন ।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা:
আলিবর্দি খান তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন । আলীবর্দির প্রথম কন্যা ঘষেটি বেগমের ইচ্ছে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ভগ্নির পুত্র শওকত জঙ্গ নবাব হবেন । ফলে তিনি সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। কয়েকজন অভিজাতের সমর্থন লাভ করেন ঘষেটি বেগম। তাদের মধ্যে রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, মীর জাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায় । প্রাসাদের ভেতরের এ ষড়যন্ত্রকে কাজে লাগায় বাংলায় বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুচতুর ইংরেজ বণিকরা । ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে তারা হাত মেলায়। অবশেষে, ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ বাধে নবাবের । ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন । অসহায়ভাবে পরাজয় ঘটে সিরাজউদ্দৌলার । এভাবেই পলাশির যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয় । আর একই সাথে বাংলার মধ্যযুগেরও অবসান ঘটে ।
Read more